Текст книги "সময়ের অন্তর"
Автор книги: Amy Blankenship
Жанр: Жанр неизвестен
сообщить о неприемлемом содержимом
Текущая страница: 3 (всего у книги 5 страниц)
অধ্যায় ৩ "তয়ার সঙ্গে দেখা হওয়া"
শিনবে খুব গুরুগম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল, ওর নীল চোখ দুটো জ্বল-জ্বল করছিল, “এখানে স্বাভাবিক মানুষজন রয়েছে, আবার সেই সব ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছে যারা স্কলারশিপ পেয়ে এখানে এসেছে, যেমন আমি আর সুকি। স্কলারশিপ পাওয়া আরও ছাত্র-ছাত্রীও আছে কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যেই কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে... যেমন, এমন কিছু ক্ষমতা যেটা আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মধ্যে থাকে না।”
“আমার মধ্যে যা রয়েছে তা হল টেলিকাইনেসিস। আমি আমার মানসিক শক্তি দিয়ে পার্থিব বস্তু নাড়াচাড়া করতে পারি।” “আর রয়েছে টেলিপ্যাথি, যার মানে হল, আমি আমার মনে মনে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।” এই কথাগুলো সে কোন শব্দ উচ্চারণ না করে বলল, তার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে যা দিয়ে সে মনে মনে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারত।
কিওকোর মুখ হাঁ হয়ে গেল যখন সে বুঝল যে শিনবের ঠোঁট নড়ছে না কিন্তু তার কথাগুলো কিওকোর মাথার মধ্যে বাজছে। সে হঠাৎ করে নিজের মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা অনুভব করল যেন শিনবের অন্তর থেকে বেরোন কথাগুলো তার মধ্যে রয়েছে... বা ওইরকম কিছু। কিওকোর ভাব-ভঙ্গি শান্ত হয়ে উঠল এবং শিনবের দিকে তার দৃষ্টি নরম হয়ে এলো।
শিনবে তারা ভ্রু কুঁঞ্চিত হওয়া এড়াতে চাইল... যখন সে কিওকোর মনের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেছিল... সেটা তাকে করতে হচ্ছিল কারণ এর জন্য তার সমস্ত মনঃসংযোগ তাকে একত্রিত করতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন তার শক্তি কিওকোর মধ্যেই সে রাখতে চাইছিল। সে তার সেই অনুভূতিকে কিছুটা নাড়িয়ে দিতে তার কথা চালিয়ে গেল। “এছাড়াও আমার মধ্যে সম্মোহন করার ক্ষমতাও রয়েছে এবং আমি বৌদ্ধ সন্যাসীদের দীর্ঘ বংশপরম্পরা থেকে এসেছি।” সে থেমে গেল যখন কিওকো হো-হো করে হেসে উঠল।
সুকি ফিরে এসে কিওকোর পাশে বসতে-বসতে বলল, “আমি জানি ওর কথাগুলি বিশ্বাস করাটা কঠিন, কিন্তু এটা সত্যিই যে ও বৌদ্ধ সন্যাসীদের বংশদ্ভুত।” এই বলে সুকি একটু দুষ্টুমি মাখানো হাসি হাসল আর তারপর আবার মুখের ভাব শান্ত করে নিয়ে বলল, “আমি ওকে কোন জিনিস না ছুঁয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি, আর সেই সঙ্গে ও প্রায় সব ধরনের মার্শাল আর্টেই বেশি পারদর্শী।”
“কিওকোকে আমার দুর্দান্ত সব প্রতিভাগুলোর সবকটাই বোধহয় জানিয়ে রাখা ভাল,” শিনবে সুকির সাথে সাথেই যোগ করল।
এটা শুনে সুকি শিনবের দিকে তাকিয়ে চোখা পাকাল, “না, তুমি যে ওটাও ভাল পারো, সেটা কিন্তু আমি ওকে বলতে পারব না!” এই বলে ও শিনবের মাথায় একটা চাঁটি কসিয়ে দিল।
“কিন্তু তারপরেও ও একজন মানুষের মতোই আচার-আচরণ করে,” হঠাৎ করেই প্রায় শূন্য থেকেই একটা কণ্ঠ ভেসে এল এবং শিনবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওই কণ্ঠের দিকে নিজের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল।
কিওকো চোখ তুলে তাকালো এবং ওর চোখ একজোড়া সোনালি চোখে আটকে গেল। ওই কণ্ঠস্বরের মালিক এতটাই সুদর্শন ছিল যা কিওকো আগে কখনও দেখিনি। লম্বা-লম্বা কালো চুল, রূপালি হাই-লাইট করা, যা কপাল থেকে লম্বা-লম্বা পরতে নিচে নামছিল। তার ত্বকে একটা অস্বাভাবিক জেল্লা ছিল এবং তার দেহের গঠন ছিল ঈর্ষণীয়। তার চোখ দুটো যেন কিওকোর চোখ দুটিকে বেঁধে ফেলেছিল যদিও সে সরাসরি কিওকোর দিকে তাকিয়ে ছিল না।
সুকি কিছুটা রাগের ভঙ্গিতে নিজের হাত দুটোকে নিজের বুকের কাছে টেনে তার দিকে বিরক্তম-মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। “ব্যস, তুমি থাকলে ওকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে আর কাউকেই দরকার হবে না।”
শিনবে সুকির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিওকোকে বক্তার পরিচয় দিল, “ওর নাম তয়া। তয়া, ও হল কিওকো। এখানে আজই ওর প্রথম দিন।”
তয়া কিওকোর দিকে ঘুরে তাকাল, এবং যে কোন কারণেই হোক যেভাবে তয়া ওর দিকে তাকাল, যেন ওকে মাপছে, তাতে কিওকো কিছুটা বিরক্ত হল। কিওকো চোখের দৃষ্টি সংকীর্ণ হল, এবং প্রথম দেখার ছাপটা তার মধ্যে দেখে যেন উবে গেল।
"আচ্ছা, তুমিই তাহলে সেই ঋত্বিকা।?" তয়া কিছুটা নিরুদ্বেগে বলল এবং ওর দিকে থেকে মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে, যেন ওকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে, বসে পড়ল।
কিওকোর চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওখানে কেউ-ই জানত না ও কিওকো একজন ঋত্বিকা। সত্যি কথা বলতে, ওর খুব কাছের পারিবারিক সদস্যরাই শুধু জানত বিষয়টা।
“তুমি এটা কীভাবে জানলে,” কিওকো হঠাৎ করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তয়ার কাছে জানতে চাইল।
ওকে এভাবে ক্রুদ্ধ হতে দেখে তয়া কিছুটা রেগে গেল। “এরকম পাগলের মতো চেঁচামেচি কোর না তো। আমি আস্তে বললেও ভালই শুনি,” তয়া রাগত কণ্ঠে ওকে বলল।
কিওকো আর তয়াকে এভাবে একে-অপরের বিরুদ্ধে খর্গহস্ত হতে দেখে সুকি ও শিনবে দু’জনেই কিছুটা থমকে গেল।
তয়ার চেতনায় শক্তি-প্রবাহিত হতে শুরু করল যেই মাত্র কিওকো তার সাথে ক্রুদ্ধ স্বরে কথা বলল, এবং সে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠল, এই ভেবে যে, কিওকোর ছোট-খাটো শরীরটায় নিশ্চয়ই বড়-সড় কোন শক্তি নিহিত আছে, যদিও সে কোনভাবে সেটা কিওকোর সামনে প্রকাশ করতে চাইছিল না।
নিঃশব্দে হলেও কিওকোর চেহারা-ছবির প্রশংসা তার মধ্যে ছিল। কিছুটা হৃদয়ের আকারের তার মুখের দু’পাশ থেকে তার সোনালি চুলগুলো এপাশ থেকে ওপাশে উড়ছিল। কিওকোর চঞ্চল সবুজাভ চোখ দুটো তার দিকে সরাসরি তাকিয়েছিল, যেটা তাকে হয় কিছুটা হলেও উত্তেজিত করে তুলেছিল। মেয়েদের মধ্যে থাকা আগুন সে পছন্দ করত এবং কিওকোর মধ্যে আগুনের অভাব ছিল না, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এ যাত্রায় সেটাই তাকে কিছুটা ধৈর্যচ্যুত করেছিল। কিওকো যেভাবে তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল সেটা তার পছন্দ হয়নি... সে সেটার দ্রুত মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল।
সে কিওকোর থেকেও কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তাকে কিছুটা ত্রস্ত করে দেবার চেষ্টা করল। “তুমি তো স্কলারশিপ পেয়েছে, তাই না... আর ও বলল তুমি নাকি একজন ঋত্বিকা!” তয়া তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গজগজ করতে-করতে কথাগুলো বলল, এতটাই কাছে গিয়ে যেন আরেকটু হলেও কিওকোর নাকে ওর নাক ঠেকে যাবে। সে হাত দুটোকে কিছুটা ভাঁজ করে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে গর্জন করল। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি দৈত্য কাকে বলে তুমি তা-ই জানো না,” সে গজগজ করে বলল, আর তখনই সে বুঝতে পারল তার তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও কিওকো ক্রমশই আরও সুন্দরী হয়ে উঠছে, আর তাতেই সে কিছুটা বিব্রত হল।
কিওকোও থতমত খেয়ে গেল, তারও রক্ত ফুটতে শুরু করল। সে জানত দৈত্য কেমন হয়। সে সারা জীবন এই সব নিয়ে পড়াশোনা করেছে এবং তার পরিবারের লোকেরা যদি ঠিক হয় তাহলে কিছু দৈত্যের সঙ্গে তার সাক্ষাতও হয়েছিল... কিন্তু তার সে কথা মনে নেই। তা হলেও, তয়ার তার প্রতি এই উদ্ধত আচরণ তার একেবারেই ভাল লাগল না, তাই সে তয়ার দিকে চোখ রেকে তার ভ্রু নাচিয়ে তাকে যেন ইশারায় বলতে চাইল সে বাজি ধরতে সত্যি-সত্যিই প্রস্তুত তো।
সুকি আর থাকতে না পেরে কিওকোর সমর্থনে মুখ খুলল, “তয়া, এত অভদ্রের মতো আচরণ করছ কেন? ও মাত্র কয়েক ঘণ্টা হল এখানে এসেছে, আর তুমি ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবার আগেই আমি ওকে আমাদের সঙ্গে থাকার অনুরোধ করতে চাইব।” কিওকোকে এতো দ্রুত হারাতে হবে এই চিন্তা থেকে সুকিকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
তয়া বিরক্ত হয়ে তার চোখের ভ্রু তুলে সুকির উদ্দেশ্যে বলল, “দেখ, ও এখনও আমার প্রশ্নের কোন উত্তর কিন্তু দেয়নি। তোমার কি মনে হয় ও এসব সামলাতে পারবে?" এই বলে সে আবার কিওকোর দিকে ফিরে তাকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
“তোমার যা ইচ্ছে করতে পার, আমি তার সবই সামলাতে পারব, গাধা,” কিওকো এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিল, ওর গলা কঠিন হয়ে উঠছিল।
সুকি আর শিনবে একে-অপরের দিকে তাকাল। তারা তাদের নিজেদের ছাড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিপতি ছাড়া অন্য আর কাউকে তয়ার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে শোনেনি, আর হয়ত কোতারো ছাড়া। এই সব দেখে তারা দু’জনেই বেশি আমোদিত হল, আর ভাবল, এই কিওকো নামের মেয়েটিকে তাদের ভাল না লাগার কোন কারণ নেই।
এর মধ্যে একজন ওয়েটার কিছু খাবার-দাবারের ট্রে হাতে নিয়ে তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, এবং কিওকো তয়ার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে নজর দিল। ছেলেটি তার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, আর তাতেই কিওকোর মনে হল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সে ছেলেটির কালো চোখ দুটিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যেগুলি তার বালক-সুলভ মুখের সঙ্গে কিছুটা বেমানান লাগছিল।
তয়ার মধ্যেকার কোন একটি বিষয় কিওকোকে আকর্ষিত করছিল... যদিও সেই অনুভূতিটা সত্যিই তার ভাল লাগছিল কিনা তা সে বুঝতে পারছিল না। তয়াকে দেখতে খুবই আকর্ষক তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাইরেও কিছু একটা কিওকোকে কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত করে তুলছিল। এই তরুণের মধ্যে থেকে একেবারে অনায়াসেই নিঃসারিত হওয়া সেই মায়াজাল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টায় কিওকো তার চোখের পলক ফেলল। বাতাবরণটা দ্রুত বদলে গেল যখন কিওকোর ঠিক পাশ থেকেই প্রায় গর্জনের মতো একটা শব্দ তার কানে এল।
তয়া তার শরীরে ঠাণ্ডা কোন কিছু আঁকড়ে ধরে ওঠার অনুভূতি পাচ্ছিল আর তাতেই সে সেই ছেলেটার উপর গর্জন করে উঠেছিল, যে তাকে তার হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য একটু ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থায় ছেলেটি যখন তয়ার চোখে চোখ রাখল তখন তার চোখ দুটি নিকষ কালো থেকে রূপালী-নীল রংয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং সে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেবিল ছেড়ে চলে গেল।
কিওকো বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সুকির দিকে তাকাল, কিন্তু সুকি তাতে কোন পাত্তাই না দিয়ে নিজের কাঁধ একবার ঝাঁকিয়ে তার সামনে রাখার খাবারগুলোতে মন দিল। কিওকো ছাড়াও শিনবেও বেশ হতচিকত হয়েছিল এবং সে তার বিহ্বলতা ঢাকার জন্য কাশার মতো করে তার মুখের সামনে তার হাত রেখে গোটা ঘরটার মধ্যে দ্রুত হেঁটে-চলে বেড়ানো যুবকটির দিকে তাকিয়ে রইল। ‘তয়া’ নামক এই যুবকটির মধ্যে থেকে এক অদ্ভুত ধরনের আবহ কিওকোর মধ্যে প্রবেশ করছিল এবং ব্যাপরটা ঠিক কী তা উদ্ঘাটন না করা অবধি সে নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না। সে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে যুবকটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে বুঝতে চেষ্টা করল।
তার লম্বা-লম্বা চুলের ছিল রাতের সবচেয়ে অন্ধকারতম অংশের চেয়েও কালো যাতে আবার রূপালী হাইলাইট করা ছিল, আর তার চোখ দুটি ছিল অসাধারণ সুন্দর... সে খুব সুন্দর ছিল। 'নিজের প্রতি মনের নিভৃত উক্তি, এভাবে ভাবার জন্য নিজেকে একটা চড় কষাও।' ওর চোখ দুটি উজ্জ্বল সোনার মতো, কোন সন্দেহই নেই। ও যেভাবে কিওকোকে দেখেছিল তা যদি না করত তাহলে ও হয়ত তার কাছে আরও বেশি সন্দর লাগত।
সুকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তয়াকে এভাবে ক্ষেপিয়ে দেবার ব্যাপারে সুকি কিওকোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। ওর নিজস্ব একটা লক্ষণরেখা আছে যেটা কোনভাবেই অতিক্রম করা ঠিক হয়নি। আর এটাও ঠিক নয় যে, কিওকোর এ ব্যাপারে কোন ধারণাই থাকবে না যে, সে আসলে এক রক্ষককে অসম্মান করছে।
“আমি দেখেছি, আগুন নিয়ে খেললে অনেক সময় নিজের হাত পুড়ে যাবার ভয় থাকে,” চুপ করে থাকা গোটা টেবিলটার জন্য শিনবে বলে উঠল, আর সঙ্গে-সঙ্গেই পুরস্কার হিসেবে বাকি সকলে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে তাকে উপেক্ষা করল।
তয়া আরেকবার কিওকোর দিকে আড়চোখে তাকাল। তাহলে, এই সেই মেয়ে যারা দিকে তার তাকাবার কথা? কিউ ভেবে আমোদিত হল। কিউ তাকে আজ সকালেই ওর আসার ব্যাপারে জানিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে তাকে পর্যাপ্তভাবে সতর্ক করে দিয়েছিল সে যেন ওকে দেখে রাখে এবং ওর যেন কোন বিপদ না হয় তার দিকে খেয়াল রাখে।
সে এইবার তার চোখ এই যুবকের উপর কেন্দ্রীভূত করল যে একটু আগেই তাদের টেবিলে ছিল। সে যেভাবে কিওকোর দিকে তাকিয়েছিল তা তাকে কিছুটা ক্রুদ্ধ করেছিল। ঋত্বিকা কি সত্যিই কোন বিপদে ছিল? সাধারণ এক মানবকে নিরাপদে রাখার ব্যাপারে কিউ এতটা আগ্রহ কেন দেখাবে? কিউ কাউকেই কোনদিন যথাযোগ্য সম্মান দেখায়নি, তাই এই তুচ্ছ মেয়েটির ব্যাপারে সে হঠাৎ এরকম ভিন্ন আচরণ করছিল কেন?
তয়া এক এক সময় এই ভেবে বিরক্ত হত যে, কিউকে কেন তার রক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু তাকে এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, সে যেভাবে তার খেয়াল রাখে তার জন্য সে কিউকের কাছে ভীষণভাবে ঋণী। সে এ-ও জানতে যে, কিউ যখনই কোন কিছু করে তার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকে এবং এই কিওকো নামক মেয়েটার ব্যাপারে তার আচরণ সেই জন্যই তাকে অবাক করেছিল।
টেবিলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এই চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করতে গিয়ে শিনবে তার হাতটা প্রায় কেটেই ফেলেছিল, আর সঙ্গে-সঙ্গে সুকির দিকে দেখল যে তার দিকেই বড়-বড় চোখ করে তাকিয়েছিল। সে তার ভাব-ভঙ্গি দিয়ে কিওকোকে হাসাতে পারে তা জানত, আর তাই সে সেটাই করার চেষ্টা করল।
"সুকি, তাহলে এসবের পরও কি তুমি আজ রাতে আমার সাথেই ক্লাবে যেতে চাও? আজ তো শনিবার, আর শনিবারের রাতটা আমি নিঃসন্দেরে তোমার সঙ্গেই নাচতে চাই, কতগুলো অজানা-অচেনা মেয়েদের সাথে নেচে-গেয়ে আমার সময় কাটবে না।” এই বলে শিনবে তার চোখে এমন একটা ভাব নিয়ে এলো যেন এই মুহূর্তে সে অজানা-অচেনা কতগুলো মেয়েদের সঙ্গে নাচছে এবং তাতে তার কী অবস্থা হচ্ছে তার প্রমাণ দিচ্ছে।
সুকি তার দিকে এমনভাবে দেখল যেন এক চড়ে তার ঘোর ভেঙ্গে দিতে চাইল এবং তারপর সে কিওকোর দিকে মুখ ফেরাল। “কিওকো, আমার একজন খেয়াল রাখার লোক চাই,” বলে মুচকি হাসল। "তুমি তো রয়েইছো, তাই না? খুবই বিপজ্জনক হবে যদি আমি লোকটার সাথে একা যাই,” এই বলে সে কিওকোর দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকাল।
এই শুনে শিনবের ঘোর ভেঙ্গে গেল আর সে বড়-বড় চোখ করে তাকাল দেখে কিওকো বেশ মজা পেল আর তার ঠোঁটের দু’পাশে হাসির রেখা দেখা গেল। “সুকি, তোমাদের সাথে যেতে আমার দারুণ লাগবে। আর আমরা একসঙ্গে থাকলে শিনবেকেও সামলাতে পারব যদি সে বেসামাল হয়ে পড়ে কখনো।”
এইবার দু’জনেই শিনবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শিকার হল এবং সে গজগজ করতে লাগল। এই সব দেখে কিওকো আর নিজেকে সামলাতে পারল না, হো-হো করে হেসে উঠল। এই দু’জনকে তার খুব ভাল লেগে গেছিল।
তয়া কিওকোকে আড়চোখে দেখেই যাচ্ছিল। ওহ্, এভাবে হাসলে ওকে দারুণ সুন্দর লাগে কিন্তু। তয়া মনে-মনেই বলে ফেলল। কোথা থেকে যে এল ধারণাটা ওর মনে? চিন্তার এই ধারাপাত সামাল দিতে-দিতে ও ধপ করে ওর চেয়ারটাতে বসে পড়ল। “ধুর ছাই!” আজ রাতে ওকে ক্লাবে যেতেই হবে, আর শুধু কিওকোকে দেখার জন্যই। শিনবে আর সুকির কথাবার্তায় হাসতে-হাসতেই কিওকো এবার পিছন ফিরল।
পিছন ফিরে যেই ও তয়ার দিকে তাকাল, তয়ার দম বন্ধ হয়ে এল, এবং তার রক্ত কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্রায় ফুটতে শুরু করে দিল। তয়া খেয়াল করল একটু আগে ও যখন তয়ার উপর রাগ দেখাচ্ছিল তখনকার থেকেও এখন ওর মধ্যে অনেক বেশি শক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। বহু দিন পর তয়া এই প্রথমবার কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছিল।
কিওকোর মুখে লেগে থাকা হাসি যখন ফুরিয়ে গেল, তখন সে পিছন ফিরে সুকির দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, আমি এখনও জানি না সোমবার আমি কোন ক্লাসে গিয়ে বসব বা তার জন্য আমাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে। আমাকে কোথায় গিয়ে খোঁজ করতে হবে তোমরা কেউ কি সে ব্যাপারে আমাকে বলতে পারো?"
সুকি উত্তর দিতে শুরু করার আগেই তয়া ওর দিকে এক পলকে তাকিয়ে ওর কথার উত্তর দিতে শুরু করে দিল। “স্কলারশিপ পাওয়া সব ছাত্র-ছাত্রীকেই একই ক্লাসে পড়ানো হয়। তাই তুমি, সুকি, শিনবে এবং অন্য সকলেই একই ক্লাসেই থাকবে। আলাদা ক্লাসে তখনই যেতে হবে যখন অধিপতি তোমাদের ক্লাস নেবেন।” চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় অলস কণ্ঠে সে কথাগুলি বলে গেল।
কিওকো ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "অধিপতি আবার কোন ক্লাসে পড়ায়?"
এইবার শিনবে ওদের কথোপকথনের মধ্যে ঢুকে পড়ে উত্তরটা দিল, এবং উত্তর দেবার সময় ওর চোখে এক ধরনের রহস্যের ছবি দেখা গেল, “আমাদের সকলের জন্য তা আলাদা। আর সেই জন্যই তিনি আমাদের প্রত্যেকের আলাদা ক্লাস নেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের মধ্যে থাকা বিশেষ দক্ষতাগুলিকে আরও বিকশিত করতে সাহায্য করেন।” সে কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসল এবং মুচকি হেসে বলল, “আমার মনে হয়, তোমার পুরুতগিরি ওখানে কিছুটা উন্নতি লাভ করতে পারবে।”
এই শুনে কিওকোর পারদ একেবারে সপ্তমে চড়ে গেল, এই ভেবে যে, অধিপতি এটা কীভাবে জানবেন যে, ও একজন ঋত্বিকা। স্কলারশিপে এ ব্যাপারে কোন কিছুই লেখা ছিল না। বিগত কয়েক বছর ধরে সে তার যে ক্ষমতাকে কবর দিতে চেষ্টা করে আসছে সেই ক্ষমতার জন্যই নাকি এই স্কুলের অধিপতি তাকে স্কলারশিপ দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এর কারণ জানার তীব্র ইচ্ছা ওর মধ্যে তৈরি হল।
নিজের খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে কিওকো কঠিন গলায় বলল, “কিছু একটা ভুল হচ্ছে হয়ত। আমি কি কোনভাবে এই মুহূর্তে স্কুলের অধিপতির সাথে কথা বলতে পারি?”
তয়া চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকাল। কিউ তাকে বলেছিল কিওকো তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতে পারে, আর সে যেহেতু ক্লাসের বাইরে কারো সঙ্গে দেখা করে না, তাই সে তয়াকে বলে রেখেছিল কিওকোর কোন প্রশ্ন থাকলে তয়া যেন তাকে তার কাছে নিয়ে আছে।
"কী হল, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?" সে কিছুটা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করল এবং সঙ্গে-সঙ্গেই কিওকোর ক্রুদ্ধ চোখের কটমট করা চাউনির পুরস্কারও পেয়ে গেল। যা হোক, কিওকো ভাবছিল সে অধিপতিকে কাবু করে নেবে। কিউয়ের উপরেও যদি তার এই ক্রুদ্ধ চোখের চাউনি কাজ করে যায় তাহলে তো ভালই। কিন্তু তয়া যেটা ভেবে ভয় পাচ্ছিল সেটা ও নিজের চোখে দেখেছিল যে, কীভাবে কিউ যে কোন ব্যক্তিকে মুখে একটি কথাও না বলে তার মধ্যে প্রবেশ করে তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারত।
“ভাল কথা, তুমি প্রস্তুত হলেই আমি তোমাকে ওর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব,” তয়া ওকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুরেই কথাগুলো বলল এটা দেখার জন্য যে, ও সেটা নেয় কিনা।
এই কথা শুনে কিওকোর রাগ কিছুটা প্রশমিত হল। সে তার খাবার প্লেটটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল, মাথা নেড়ে তয়ার ধাপ্পাবাজির যোগ্য জবাব দেবার জন্য বলে উঠল, “তুমি প্রস্তুত হলেই আমিও প্রস্তুত।” সে তার একটা দিকের চোখের ভ্রু তুলে ওর চ্যালেঞ্জের জবাব দিল।
"এত তাড়া কীসের?" তয়া একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। “আমি চাই তুমি তোমার রাগের হাঁড়িতে একটু ঢাকনা চাপা দাও কারণ ও সেটা ধরে ফেলতে পারে,” একটু হেসে তয়া ওকে কথাগুলো বলল, এই ভেবে নিয়ে যে ও ঠিক কী করতে চলেছে সে ব্যাপারে ওর কোন ধারণাই নেই।
কিওকো চোখ ছোট করে তয়ার দিকে তাকাল এবং উঠে দাঁড়াল, তারপর সুকি আর শিনবের দিকে পিছন ফিরে তাকাল। “আমার হয়ে গেলে আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলব, তোমরা যদি আমাকে এসে নিয়ে যেতে পার। আমি আমার ঘরেই অপেক্ষা করে থাকব আর আমরা আজ সন্ধ্যায় যাবার কথা ভাবতে পারি।” সে সুকিকে ইশারা করল এবং তারপর তয়ার দিকে ফিরে তাকাল এবং ভাবলেশহীন কণ্ঠে তাকে বলল। “মানে, আমি যদি থাকার সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে।”
তয়া মুচকি হেসে কিওকোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং কিওকো দেখল সে ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে চলে যেতে যেতে অন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে কিছু ইশারা করল। কিওকো লক্ষ্য করল ওই ইশারা পাওয়া মাত্রই ঘরে উপস্থিত অন্য সব ছাত্র-ছাত্রীরা দ্রুত তার পিছনে-পিছনে ঘর ছাড়ল। “ও কে? স্কুলের দাদা নাকি?”
কিওকো তাকে নিজেকে তার পিছনে-পিছনে ছুটতে দেখার সুখ দিতে চাইল না, তাই সে নিজের সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ঘর থেকে বেরোল এবং ইচ্ছে করেই ওর অনেকটা পিছনে নিজেকে রাখল। কিন্তু ওর উপর রেগে থাকা সত্ত্বেও কিওকোর চোখ যখন তয়ার পিছন দিকটাতে পড়ল ও কিছুটা লজ্জারুণ হয়ে উঠল। কিওকো দেখল ওর লম্বা-লম্বা চুলগুলো তয়ার নিতম্বকে ঢেকে দিয়েছিল, যা তার নিচে থাকা শক্তপোক্ত গড়নকে যেন আরও প্রকট করে তুলছিল যেটা তাকে আরও বিব্রত করে তুলল। রেগে আগুন হওয়া ও সৌন্দর্য খুব ভয়ংকর একটা সমন্বয়।
নিজের চোখের অসংযমী নজরকে দুষতে-দুষতে মাথাটাকে নাড়িয়ে নিয়ে সে তয়ার পিছন-পিছন এগিয়ে যেতে লাগল। “যাকে তুমি সহ্যই করতে পারছ না তার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেতে গেলে মাথা মোটা না হলে চলে না,” কিওকো নিজে-নিজেই বিড়বিড় করে বলল। “বিরক্তিকর... শত্রুর বাড়া... উদ্ধত... এ সবই হতে পারে, সুন্দর কখনই নয়,” এই ভেবে সে একটু মুচকি হাসল। এইবার কিছুটা হালকা লাগছিল।
হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার শিড়দাঁড়া সংকেত দিল এবং সে তার চোখের দৃষ্টি উপরে তুলল এবং তার চোখকে বিদ্ধ করতে থাকা একজোড়া চোখের উপর গিয়ে আটকে গেল। সিঁড়ি একেবারে উপরের ধাপে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার গাঢ় কালো-বাদামী রংয়ের চুলগুলো তার কাঁধের দু’পাশ দিয়ে পিছনে ঢলে পড়ছিল এবং তার চোখ দুটো মধ্যরাতের গাঢ় অন্ধকারের মতো গভীর ছিল। ছেলেটি খুবই আকর্ষক ছিল, কিন্তু কেন যেন কিওকোর অনুভূতিটা ছিল... ভীত।
সে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। 'কিওকো, নিজেকে একটু সামলাও। যাকেই দেখছ, তার সম্বন্ধেই কিছু না কিছু আগে থেকেই ভেবে নেওয়া বন্ধ কর,' সে নিজেই নিজেকে কথাগুলো বলল এবং এমনকি আবার তার পান্না-সম চোখ দুটিকে সেই ছেলেটির চোখে ফিরিয়ে নেয়ে গেল।
“আমাদের ক্যাম্পাসের এই সেই মেয়ে যে একজন ঋত্বিকা।”
কিওকো তার দুই কাঁধ জুড়ে একটা শক্ত-পোক্ত হাত চালিত হবার অনুভূতি পেল এবং সকালে যে ছেলেটি তাকে তার ঘর অবধি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল তার কণ্ঠস্বর মনে করে সে পিছন ফিরে তাকাল। সে তার দুই গালে তার চুলের শুড়শুড়ি অনুভব করল যেহেতু হঠাৎ করেই কোথা থেকে হাওয়া এসে তার গাল ঘেষে চলে যাচ্ছিল।
কিওকো ওর দিকে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকাল এবং হাসল, কিন্তু একই সঙ্গে একটু নিচু হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্তও করল। “তোমার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে ভাল লাগছে, কোতারো। আজ সকালে আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছিলে তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ,” কিওকো কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল, এই ভেবে যে, কোতারো হয়ত তার সঙ্গে ততটা পরিচিতের মতো আচরণ করবে না। সে ভাবল কোতারো বেশ ভাল ছেলে এবং সেইটুকুই, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, সে তার দুই কাঁধে হাত রেখে কথা বলতে পারে।
কোতারো এ সবে কোনভাবেই প্রভাবিত না হয়ে দ্রুত কিওকোর একটা হাত তার মধ্যে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, "তোমাকে কি আর কোথাও পৌঁছে দিতে পারি, কিওকো?" সে কিওকোর পান্না-সম চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, এটা জেনেই যে সে আগেও এই চোখ দুটিকে দেখে... কোন এক জায়গায়। আর তার মনের মধ্যে আবছা একটা অনুভূতি এইরকম হচ্ছিল যে, সে হয়ত এই দুই চোখে ডুবও দিয়েছিল কখনও।
কিওকো সিঁড়ির উপর তাকিয়ে দেখল তয়া থেমে গেল এবং ঘুরে তাকাল, তাকে আবার ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে। সে হলফ করে বলতে পারে সে তয়াকে গজগজ করতে শুনেছিল, তার উপরেই হোক বা কোতারোর উপরে, কার উপর সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারল না।
কোতারোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তয়ার কোন ধারণা ছিল না, কিন্তু সে যে কিওকোর সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল সেটা ওর পছন্দ হচ্ছিল না। ভিতর থেকে উঠে আসা একটা গর্জন-সহ তয়া সতর্ক করে দিল, “আমি সেটা দেখে নেব, কোতারো, যদি না তুমি ওকে কিউয়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যেতে চাও।” সে কটমট করে কোতারের দিকে তাকাল, এটা জেনেই যে, কোতারো ক্লাস ছাড়া বা ডেকে না পাঠানো ছাড়া কিউয়ের ধারে-কাছে ঘেঁষতে চাইবে না।
কোতারো কিওকোর হাতটা ছেড়ে দিল, “আশা করি সব ঠিকঠাকই আছে, কিওকো।” এই বলে সে তয়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আবার কিওকোর দিকে ফিরল, “এখানকার বাসি খাবার-দাবার সম্পর্কে খেয়াল রেখে চলবে। ও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তোমার হয়ে আমি ওর ব্যবস্থা করে দেব।” কোতারো তয়ার দিকে কিছুটা দাম্ভিক দৃষ্টিতে তাকাল আর তারপর কিওকোর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে পিছন ফিরল এবং সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে থাকল।
কিওকো তয়াকে ফোঁসফোঁস করতে শুনতে পেল এবং ওর দিকে তাকাল এবং দেখল ও বারান্দা ধরে হাঁটতে শুরু করেছে, সেই রাস্তাতেই যে রাস্তা দিয়ে আজ সকালে কিওকো তার ঘরের দিকে গেছিল।
এইবার কিওকো দ্রুত পায়ে হেঁটে তয়াকে ধরে ফেলল যখন সে সেই ঘরটার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল যেটার দরজায় লেখা ছিল প্রবেশ নিষেধ । কিওকোর জানতে ইচ্ছে করছিল তারা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। তয়ার পিছনে-পিছনে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ করে তার মনে হল তয়া তো ওকে ওর ঘরের দিকেই নিয়ে চলেছে। সে সত্যি-সত্যিই কিওকোর ঘরেরে সামনে এসে থেমে গেল, এবং ওর দিকে তাকাল, আর কিওকোও ওর দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না সে তার ঘরের অপর প্রান্তে থাকা দরজাটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সেটার সামনে গিয়ে তাতে টোকা দিল।
কিওকো থতমত খেয়ে গেল। অধিপতি তার ঘরের মধ্যে থাকা দরজার অপর প্রান্তে থাকে? কিওকোর আরও একবার তার ভাইয়ের কথাটা মনের মধ্যে এসে খোঁচা দিল। ‘হতেই পারে না!’ ওপাশ থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই তয়া দরজাটা ঠেলে খুলে নিয়ে কিওকোকে ঠেলে নিজের সামনে রেখে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
কিওকো সঙ্গে-সঙ্গে পিছন ফিরল। “তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু দয়া করে আমাকে ঠেলো না,” সে তয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিল, “বা আমার গায়ে হাতও দিও না। আমি তো তোমাকে কিছুই করিনি।” এই বলতে-বলতে সে খেয়াল করল তয়া তার পিছনে কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
কিওকোর কাঁধে একটা হাওয়ার ঝাপটা লাগল। কিওকো সেই কাজটাই করে ফেলল। ওকে কি সবসময়েই কারো উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে এটা না ভেবেই যে, সে কোথায় রয়েছে এবং কে তাকে দেখছে?
কিওকোকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে তয়া মুচকি হাসল, চোখ নামিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল যেটা এই মুহূর্তে ছোট্ট হয়ে গেছিল। "তুমি কার সঙ্গে কথা বলতে চাও বলেছিলে না?" কিওকো যখন পিছন দিকে ফিরল না, তয়া তার চোখটা ছোট করে পিছনে কিউয়ের দিকে তাকাল, যে সেই সময় বসার ঘরের দরজার হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিওকোর দিকে তাকিয়েছিল যাকে এই মুহূর্তে নিথর একটা দেহ মনে হচ্ছিল।
'কী হচ্ছেটা কী?’ তয়া মনে-মনে ভাবল। কিওকো এভাবে তার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রয়েছে কেন? কিছুটা অবধি, এর জন্য তার মধ্যে যে ঈর্ষার অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেটাকে সে চিহ্নিত করতে চাইছিল না। এই মুহূর্তে তার মনের মধ্যে এমন একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল যেটা তাকে বলছিল সে যেন এক্ষুণি সামনে এগিয়ে যায় এবং কিওকো ও কিউয়ের মাঝে দাড়িয়ে কিউয়ের দৃষ্টি থেকে কিওকোকে আড়াল করে। সে ওকে রক্ষা করতে চাইছিল।
কিউও কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার বাকশক্তি হারিয়েছিল, হাজার বছরের ব্যবধানে প্রথমবারের জন্য কিওকোকে এভাবে তার এতটা কাছে দেখে। কিওকোর চারিপাশে ঘুরতে থাকা দমকা বাতাস তাকে স্মৃতি হাঁতড়াতে প্ররোচিত করল... সেই একই অকাট্য প্ররোচনা যা অতীতেও তাকে ওর কাছে নিয়ে এসেছিল, যা আজও হারিয়ে যায়নি।
ওর সোনালি চোখের উদাসীন দৃষ্টি কিওকোর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষকের উপর পড়ল। “তুমি যেতে পারো, তয়া।” একটা বিপজ্জনক হুমকিপূর্ণ ভারী আওয়াজ বেরিয়ে এলো ওর গলা থেকে।
তয়া গলাতেও এক ধরনের গর্জন তৈরি হচ্ছিল এবং এবং তার হাতের তালু দুটো ক্রুদ্ধ মুঠোয় পরিণত হচ্ছিল কারণ স্মৃতির গভীর গহ্বর থেকে এক ধরনের অজানা ভয়ের অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল মনের ভিতর থেকে। আর একটিও কথা না বলে তয়া ঘুরে দাঁড়াল এবং দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেল।
তয়ার চলে যাওয়াটা কিওকো দেখল কিন্তু একই সাথে তার মনের ভিতরটা তখন একগুচ্ছ স্মৃতি আর চিন্তায় তোলপাড় হচ্ছিল। হঠাৎ করেই তার মধ্যে তয়ার পিছনে-পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে যাবার একটা তীব্র ইচ্ছার ঢেউ খেলে গেল। কিন্তু শেষ অবধি নিজেকে এভাবে ভীতু প্রতিপন্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে আস্তে করে তার চিবুক ওপরে তুলল এবং মুহূর্তের মধ্যে মনোবল ফিরে পেল, এবং শেষ অবধি পিছন ঘুরে যখন চোখ রাখল সে যা দেখল তাকে বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছা হল না।
লম্বা বিজনে-সস্যুট পরিহিত একজন বয়স্ক লোককে দেখার বদলে সে তার মুখো-মুখি যাকে দেখল... তার সোনালি চোখ কিওকোর চোখ দুটিকে গলিয়ে দিয়েছিল এবং তার সেই চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেও সে পেরে উঠল না। তার রূপালী চুলের ঢেউ তার দুই কাঁধের উপর নেমেছিল, আর তার দেহটা দেখে মনে হচ্ছিল তা যেন কোন দক্ষ ভাস্করের ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে তৈরি। সে ছিল খুব লম্বা ও খুব সুপুরুষ একজন যুবক, সেই সঙ্গে তার গোটা শরীর জুড়ে একটা রাজকীয় ঔদ্ধত্য বিরাজ করছিল, আর মুখটা যেন ছিল ঈশ্বরের উপহার।
কিওকো তাৎক্ষণিকভাবে তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এ কী হল তার? ও তো এখানে প্রশ্ন করতে এসেছিল, রূপের বশে বশীভূত হতে নয়। কিওকো যখন তার চোখ খুলল, পুরুষটি তখন তার অনেক কাছে চলে এসেছিল। সে সঙ্গে-সঙ্গে সেই রাজকীয় ও উদ্ধত চেহারা-ছবি থেকে এক কদম পিছনে চলে গেল এবং পিঠে দরজার স্পর্শ পেল... যা তাকে আটকে রাখছিল।
সে কী করেছে তা উপলব্ধি না করেই কিউ তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু যেই মাত্র সে বুঝতে পারল কিওকো পিছিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে সে তার মার্জিতভাবে তার চোখের ভ্রু দুটি তুলল এবং একটা হাত পাশে থাকা সোফার দিকে নির্দেশ করল। "আপনি কি একটু বসতে চাইবেন, মিস হোগো?" সে জানত কিওকোর মনে তার উদ্দেশ্য নানান প্রশ্ন আছে। যদি না থাকত তাহলেই বরং সে কিছুটা হতাশ হত।
কিওকো কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল কিন্তু তারপরেই উদ্ধত ভঙ্গিতে তার চিবুক তুলল, সোফার দিকে এগিয়ে গেল, কিউয়ের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে বসে পড়ল, আর কিছু না হোক তাতে অন্তত তার মস্তিস্ক ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারবে এই আশায়। কিওকো ভিতরে-ভিতরে একটু হাসল।
"প্রথমেই যেটা আমি জানতে চাইব তা হল, আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি একজন ঋত্বিকা?" সে সতর্ক দৃষ্টিতে কিউয়ের দিকে তাকাল এবং প্রায় অদ্ভুত একটা আচরণ করল যখন সে দেখল কিউ অন্য দিকে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে না বসে সোফায় তার পাশে বসে পড়ল। কিওকো তার শরীরটা একটু সরিয়ে তার দিকে তাকাল, যাতে তাকে আরও সরে না যেতে হয় এবং তাতে তার ভয় প্রকাশিত না হয়ে পড়ে।
'বেশ, তুমি তাহলে খেলতে চাও,' কিউ মনে-মনে এটা ভেবে বেশ আমোদিত হল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মনের গোপন ভাব ঝেড়েও ফেলল। "আপনার কী থেকে মনে হল যে আপনি যে একজন ঋত্বিকা তা আমার অজানা থাকবে?" স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভাষায় সে পাল্টা প্রশ্ন করল। সে যখন কিওকোর পানের পাতার মতো আকৃতির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছিল তখন তার তুলনায় কিওকোর চেহেরাটা খুবই ছোট লাগছিল।
কিওকো তার মুখের সমস্ত বলিরেখাগুলিকে নজর করছিল তার মধ্যে কোনরকম আবেগের ইঙ্গিত ধরা পড়ে কিনা তা দেখার জন্য এবং সেই রকমই একটা ইঙ্গিত পেয়ে কিছুটা অবাক হল। সে যেন কোন ভাস্করের নিখুঁত ও শান্ত হাতে তৈরি কোন মানুষ, আর সেটাই কিওকোকে বেশ বিব্রত করছিল।
"আপনি কি সবসময়েই প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে থাকেন নাকি, মিস্টার…?” সে কিছুটা তোতলার মতো কথাগুলো বলে ফেলল এমনকি তার নাম পর্যন্ত না জানতে চেয়ে।
কিউ হাসল, কিন্তু মনে-মনে, তাই কিওকোর চোখে তা ধরা পড়ল না। তবে সে বলতেই পারত কিওকোর মধ্যে এখনও প্রাণবন্ততা রয়েছে এবং তাতে সে এতটুকু হতাশ হয়নি। বরং সে তার মধ্যে আরও প্রাণোচ্ছলতা দেখতে চাইছিল। "মিস্টার লর্ড, কিন্তু আপনি আমাকে কিউ বলেই ডাকতে পারেন, যদি না লর্ড নামটাই আপনার বেশি পছন্দ হয়।" এরপর ও খুব উষ্ণ দৃষ্টিতে কিওকোর মুখের উপর তাকিয়ে ওকে একেবারে কাবু করে দিল।
কিওকোর উপর তার প্রভাব ভালই পড়ল, "কেন… আমি… কি… এখানে?" সে প্রত্যেকটা শব্দ আস্তে-আস্তে এবং আলাদা-আলাদা করে বলেছিল, যেন সে কোন বাচ্চার সাথে কথা বলছে। কিউ তার এর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসে সেটাই দেখার। ‘মিস্টার লর্ড না ছাই।’ কিওকো নিজের মধ্যেই তাচ্ছিল্যের সুর ভরে নিল, তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই।
কিওকোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিউয়ের সোনালি চোখ দুটি জ্বলে উঠল এবং ছোট হয়ে কিওকোর পান্না রংয়ের চোখের উপর কেন্দ্রীভূত হল। সে কিওকোর দিকে একটু ঝুঁকল, এটা বুঝতে পেরেই যে এতে কিওকো একটু ঘাবড়ে যাবে। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল।
“আপনার পৌরোহিত্যের শক্তি দুর্বল এবং অপ্রশিক্ষিত, না হলে আপনি বুঝতে পারতেন আমি কীভাবে বুঝলাম আপনি একজন ঋত্বিকা,” সে কিছুটা হিসহিস শব্দে কথাগুলো কিওকোকে বলল, শুধু একবারে জন্য তার শান্তভাব হারিয়ে যার পরেই আবার তা তার চোখে-মুখে ফিরে এসেছিল। “আমি আপনাকে মার্শাল আর্ট শেখাব, আপনার শক্তি বৃদ্ধির শিক্ষা-সহ... যেটার অভাব আপনার মধ্যে রয়েছে।”
কিওকোর কাছে তার এই কথাগুলোর মধ্যে শেষেরটা কিছুটা অপমানের মতো লাগল। কিছুটা মাথা-গরম স্বভাবের বলে পরিচিত কিওকো এবার কিউয়ের দিকে ঝুঁকে প্রায় তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল এবং তার ভঙ্গিমায় বিদ্রূপ ভরে নিল। “এমনও হতে পারে যে, আমি আমার প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে রেখেছি, আর আমার সমকক্ষ কিছু সামনে এলেই আমি তা দেখিয়ে দেব।” তার রাগ, বা তার নির্বুদ্ধিতা, এক মুহূর্তের জন্য তাকে ভয়শূন্য করে তুলেছিল, ঠিক কোনটা সে ব্যাপারে সে ততটা নিশ্চিত ছিল না।
কিউ আরও একটু কাছে ঝুঁকল, তার ঠোঁট দুটো প্রায় কিওকোর ঠোটের কাছে নিয়ে গেল যাতে তার গরম নিঃশ্বাস কিওকো অনুভব করতে পারে। তারপর সে ঠাণ্ডা গলায় ফিসফিস করে বলল, “ঋত্বিকা।”
Правообладателям!
Данное произведение размещено по согласованию с ООО "ЛитРес" (20% исходного текста). Если размещение книги нарушает чьи-либо права, то сообщите об этом.Читателям!
Оплатили, но не знаете что делать дальше?